
যশোর বোর্ডের প্রশ্ন ব্যাংক দুর্নীতি: ভুয়া প্রতিষ্ঠানে অর্থ প্রেরণ, কোটি কোটি টাকার হিসেব নেই
জেমস আব্দুর রহিম রানা, যশোর
যশোর শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্ন ব্যাংক কি কেবল শিক্ষার মানোন্নয়নের একটি পদ্ধতি ছিল, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে ছিল বড় ধরনের আর্থিক দুর্নীতি? শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সংগৃহীত কোটি কোটি টাকার কোনো সঠিক হিসাব না থাকায় এই প্রশ্নটি এখন সামনে চলে এসেছে। এই গুরুতর অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করার পর বোর্ডের ভেতরে ও বাইরে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
সংশিষ্ট শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিগত হাসিনা সরকার পরিকল্পিতভাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের চক্রান্ত শুরু করেছিল। এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান যিনি এন আই খান নামেই বেশি পরিচিত। তারই পরিকল্পনায় পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে ২০১৬ সালে যশোর শিক্ষা বোর্ডে তৈরি করা হয় প্রশ্ন ব্যাংক। আর এই কাজে বোর্ডের পক্ষে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী কামাল হোসেন। কোনো প্রকার টেন্ডার আহ্বান ছাড়াই নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ২৫ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে কেনা হয় প্রশ্ন ব্যাংক সফটওয়্যার। এই প্রশ্ন ব্যাংক সফটওয়্যার চালু করার মাধ্যমে এক অফিস আদেশে পর্যায়ক্রমে বোর্ডের সকল মাধ্যমিক ও নিন্মমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত সকল অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কার্যক্রম বোর্ড গ্রহণ করে। ওই আদেশ বলে বোর্ডের অধিভুক্ত প্রায় ৩ হাজার হাই স্কুলের প্রায় ৪৫ হাজার শিক্ষক স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন কার্যক্রম থেকে ছিটকে পড়েন। তাদেরকে স্কুলের অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের জন্য বোর্ডের মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য করা হয়।
সূত্র বলছে, ২০১৬ সালে ১৬১ হাই স্কুলের ১০ম শ্রেণির ৪টি বিষয়ে প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে প্রশ্ন ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৭-১৮ সালে ৮ম শ্রেণির সকল এবং ৯ম ও ১০ম শ্রেণির ১৭টি বিষয়ের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। এরপর ২০২৪ সাল পর্যন্ত যশোর শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত ২ হাজার ৭শ' ৯৬টি নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক (সকল) বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির ৫টি বিষয়, ৮ম শ্রেণির সকল বিষয়ে অর্ধবার্ষিক ও ৯ম শ্রেণির সকল বিষয়ে অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষা, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের প্রাক-নির্বাচনী ও নির্বাচনী পরীক্ষা প্রশ্ন ব্যাংকের মাধ্যমে অনলাইনে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করে গ্রহণ করা হয়। বোর্ড কর্তৃপক্ষ এই সকল পরীক্ষায় ছাত্র প্রতি ১০ টাকা হারে ফি আদায় করে। যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৫-৬ কোটি টাকা। এই অর্জিত অর্থ ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট খাতের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি। তবে প্রতি মাসে সফটওয়্যার মেইনটেন্যান্স খাতে ৪৫ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়। বর্তমান চেয়ারম্যানের সময় তদন্ত করে টাকা পাঠানো মেইনটেন্যান্স কোম্পানির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এছাড়া অতীতে জড়িতরা দাবি করেন, ১২০ জন শিক্ষককে একটি করে ট্যাব ও শতাধিক স্কুলকে প্রিন্টার দেওয়া হয়েছে। আর মডারেটরদেরকে ৮৫টি বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নের জন্য মডারেটরদের সম্মানী দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কত করে, কতজন শিক্ষক এ টাকা পেয়েছেন তার কোনো তথ্য দিতে পারেনি কেউ। এছাড়া জড়িতদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির পরীক্ষায় কোনো ফিস নেওয়া হতো না, কিন্তু শিক্ষকরা দাবি করেছেন যত শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিত তার চেয়েও বেশি শিক্ষার্থীদের জন্য (যাদের নামে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছিল) তাদের প্রত্যেকের জন্য ফিস জমা দিতে হতো বোর্ডে। এ বিষয়ে প্রশ্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী কামাল হোসেন কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
সূত্র বলছে, পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে এন আই খানের চিন্তা ও ইঞ্জিনিয়ার কামালের পরামর্শে যশোর শিক্ষা বোর্ডে প্রশ্ন ব্যাংক পদ্ধতি চালু করা হলেও তা গত ৮ বছরে অন্য কোনো শিক্ষা বোর্ড গ্রহণ করেনি। এমনকি বার বার চেষ্টা করেও সাবেক শিক্ষা সচিব দেশের অন্য কোনো বোর্ডে এই প্রশ্ন ব্যাংক চালু করতে পারেননি। গত ৮ বছরে এই প্রশ্ন ব্যাংকের মাধ্যমে বোর্ডের অধিভুক্ত সকল স্কুলের ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কমপক্ষে ৫-৬ কোটি টাকা আয় করেছিল যশোর শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
বোর্ড সংশিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, ২০১৬ সাল থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ এই সময়কালে প্রশ্ন ব্যাংক থেকে অর্জিত প্রায় ৫-৬ কোটি টাকার একটি বড় অংশ পকেটস্থ করেছেন সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহসান হাবীবসহ (তার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে) বোর্ড সংশিষ্ট অনেকেই। আর এই অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির বিষয়ে অভিযোগ পেয়ে দুদক অনুসন্ধান শুরু করেছে। এমনকি অনিয়মের মাধ্যমে বেশি টাকা গ্রহণকারীরা দুদকের নির্দেশে অতিরিক্ত গৃহীত টাকা ফেরত দিতেও বাধ্য হন বলে জানিয়েছেন বর্তমান বোর্ড চেয়ারম্যানসহ কর্মকর্তারা।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকগণ বলেন, সাবেক শিক্ষা সচিব এন আই খান ও তার ছত্রছায়ায় থাকা বোর্ডের ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা উপ-সহকারী প্রকৌশলী কামাল হোসেনের প্রশ্ন ব্যাংক পদ্ধতিটি অর্থ কামানোর একটি হাতিয়ার ছিল। বিগত বছরগুলোতে যশোর শিক্ষা বোর্ডের আওতায় পরিচালিত প্রায় ৩ হাজার হাই স্কুলের লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও তাদের শিক্ষকদের জিম্মি করে প্রায় ৫-৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বোর্ডের সাবেক ও বর্তমান কতিপয় কর্মকর্তারা।
এক পর্যায়ে জুলাই পরবর্তী মুক্ত পরিবেশে চলতি বছরের ৭ মে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি যশোর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জহরুল ইসলামসহ বিভিন্ন হাই স্কুলের একাধিক প্রধান শিক্ষক যৌথ স্বাক্ষরে শিক্ষা বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক আসমা বেগম বরাবর একটি লিখিত আবেদন করে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রবর্তিত ও প্রচলিত নীতিমালা পরিবর্তন ও সংশোধনের আবেদন জানান। বিষয়টি বোর্ডের আওতাধীন অন্যান্য জেলার শিক্ষক নেতৃবৃন্দও সমর্থন করেন। যার প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ৮ মে যশোর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. মো. আব্দুল মতিন স্বাক্ষরিত এক পত্রে যশোর শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক প্রশ্ন ব্যাংকের কার্যক্রম স্থগিত করেন। একই সঙ্গে সকল বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে জানিয়ে দেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোছাম্মৎ রহিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর এক প্রজ্ঞাপনের নির্দেশনা মোতাবেক যশোর বোর্ডের প্রশ্ন ব্যাংক স্থগিত করা হলো। এখন থেকে বিদ্যালয়ের সকল অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা স্ব স্ব শিক্ষকবৃন্দ বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নপত্র তৈরি করে পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। অন্য কোনো উৎস থেকে সংগৃহীত প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা গ্রহণ করা যাবে না।
এদিকে প্রশ্ন ব্যাংক স্থগিত হওয়ার খবরে বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী কামাল হোসেনসহ সুবিধাবাদী নেতারা বিপাকে পড়েন। তারা সরকারি প্রজ্ঞাপন এবং বোর্ড চেয়ারম্যানের জারি করা নির্দেশনাকে সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে প্রশ্ন ব্যাংকের পক্ষে জনমত গঠনে নানা কৌশল আঁটতে শুরু করেন। তারা তাদের মতাদর্শের কতিপয় শিক্ষককে দিয়ে প্রতিনিয়ত বোর্ড চেয়ারম্যান, সচিব, কন্ট্রোলার, স্কুল পরিদর্শক, ডেপুটি স্কুল পরিদর্শক থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্মকর্তাকে ফোনের মাধ্যমে ফের প্রশ্ন ব্যাংক চালুর পক্ষে তদবির শুরু করেন। যুক্তি হিসেবে তারা বলেন, প্রশ্ন ব্যাংক একটি ভালো পদ্ধতি। এর মাধ্যমে বোর্ডের সকল শিক্ষার্থী একই প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে পারবে। কোচিং ব্যবসা ও গাইড ব্যবসা বন্ধ হবে। শিক্ষার মান বাড়বে।
চৌগাছা উপজেলা শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সভাপতি কামাল আহমেদ বলেন, হাজার হাজার ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে উৎখাত করেছি। সেই ফ্যাসিস্টের চরম সুবিধাভোগী দোসরদের কোনো তথ্য ও তত্ত্ব এখন আর গ্রহণ করার প্রশ্নই আসে না। বরং প্রশ্ন ব্যাংকের নামে গত ৮-৯ বছরে যে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে তার বিচার করতে হবে। এই আত্মসাৎকৃত টাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ফেরত দিতে হবে।
বাঘারপাড়া মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করা একটি গুরুতর অপরাধ।’
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি যশোর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রশ্ন ব্যাংকের নামে দীর্ঘ আট বছর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। আমাদের আবেদনের ভিত্তিতে বর্তমান চেয়ারম্যান এটি স্থগিত করেছেন, কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা আবার এটি চালুর চেষ্টা করছে।’
এ বিষয়ে প্রশ্ন ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামাল হোসেন তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেননি। তিনি শুধু বলেন, ‘বোর্ডের সফটওয়্যারের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে, যার হিসাব সফটওয়্যারে আছে।’
যশোর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. মো. আব্দুল মতিন বলেন, ‘প্রশ্ন ব্যাংকের বিষয়টি বোর্ডের বিগত প্রশাসনের সময়ের কার্যক্রম। সরকার যখন এটি বন্ধ করে দিয়েছে, তখন আমাদের কিছুই করার নেই।’
বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আসমা বেগম জানান, ‘আমি বোর্ডে যোগদানের পর এই বিষয়ে অনেক অভিযোগ পেয়েছি। প্রশ্ন ব্যাংকের অর্থনৈতিক বিষয়ে দুদকের তদন্ত চলছে, তাই এই মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে আমি যোগদানের পর অস্তিত্বহীন কোম্পানির টাকা পাঠানো বন্ধ করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটি পুনরায় চালু করা বা না করার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার।’
Comment / Reply From
You May Also Like
Latest News
Vote / Poll
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলা বন্ধ করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ যথেষ্ট বলে মনে করেন কি?
হ্যাঁ
না
মন্তব্য নেই
0%
0%
0%
Popular Posts
Archive
Please select a date!
Submit