
গচ্ছা যাচ্ছে জলবায়ু ফান্ডের কোটি টাকার সৌরবাতি প্রকল্প
সাইদুল ইসলাম মন্টু,বেতাগী
বরগুনার বেতাগী পৌরসভায় গচ্ছা যাচ্ছে জলবায়ু
পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য সৌরবাতি স্থাপন প্রকল্প। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষনের অভাব,অনিয়ম, স্থানীয় চাহিদা,বাস্তব পরিস্থিতি,পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন, গবেষনা ও অভিজ্ঞ মানুষের মতামত যাচাই না করায় প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও খেয়াল-খুশিমতো হাতে নেওয়ায় যা ক্ষতিগ্রস্থ পৌরবাসীর কাজে আসছে না বরং জলবায়ু তহবিলের বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় হয়েছে।
দেশের উপকূলীয় এ জনপদে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের অর্থায়নে পৌরসভার বিভিন্ন গুরুত্বপর্ণ সড়কে সৌরবাতি স্থাপনের পাঁচ থেকে ছয় মাস পর থেকেই বাতিগুলো নষ্ট ও অস্তিত্ব হারাতে থাকে। ঠিকমত জ্বলছে কি-না মাঝে মাঝে তা পরীক্ষা করার কথা থাকলেও স্থাপনের পর কোনো খোঁজই রাখেনি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও পৌরসভা। পৌর নাগরিক সমাজের অভিমত ভুক্তভোগি ও অভিজ্ঞদের মত
নিয়ে কার্যকরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে জলবায়ূ ফান্ডের এ প্রকল্পের ক্ষতি ও সমস্যা অনেকটা পুষিয়ে উঠা সম্ভব হবে। সরজমিনে দেখামেলে, সন্ধ্যা হলেই সড়কে আঁধার নেমে আসে। বাড়ছে দূর্ঘটনা,চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রভাব মোকাবেলা করা, পরিবেশের উপর কার্বন নি:সরণ কমানো এবং সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়ানো কিন্ত যে উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি নেয়া হয়েছিল, তা কার্যত ব্যহত হয়েছে। পৌরবাসীর এতে ক্ষোভের শেষ
নেই। ‘জলবায়ু’, ‘পরিবর্তন’, ‘প্রভাব’ আর 'মোকাবিলা- এই চার শব্দ জুড়ে দিয়ে নেওয়া হয় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টফান্ডের (সিসিটিএফ) প্রকল্প। কিন্ত সংকট কাটিয়ে উঠতে এর প্রয়োজনীয়তা কতখানি- তা যাচাইয়ের নজিরও তেমন একটা নেই। স্থানীয়দের বক্তব্য এখানেও তাই ঘটেছে। বেতাগী পৌরসভার তথ্যানুযায়ী, পৌরসভা প্রস্তাবিত এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন অধিশাখা অনুমোদিত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এ প্রকল্পের প্রতিটি ১ লাখ ২৫ হাজার ৫০০ টাকা করে মোট ৯৯ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ে পরিবেশবান্ধব সোলার স্ট্রিট লাইট ফিটিং ও ফিক্সিং কাজ করা হয়। ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাকেরগঞ্জের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স উপকূল
সোলার সিষ্টেম পৌর দরপত্রের কার্যাদেশ পেয়ে ২০২৩ সালে ফ্রেরুয়ারিতে কাজ সম্পন্ন করে। বেতাগী পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্তম্ভ ‘দুর্জয় বেতাগী’ সাবেক মেয়র শাহজাহান কবিরের বাড়ী পর্যন্ত পাকা সড়কের পাশে স্থাপন করা ৮টি সৌরবাতির সেখানে ৬৩,৬৪,৬৫ ও ৬৬ নম্বর ৪টি
খুঁটির সামান্যও কোন অস্তিত্ব নেই। আর ৬১ নম্বর খুঁটি পানিতে পরে আছে।
সঙ্গে আনুষঙ্গিক অন্যান্য যন্ত্রাংশও পানিতে কাদায় লেপ্টে আছে এমনি হ-য-ব-র-ল।
কচুয়া-বেতাগী পুরানো খেযাঘাট এলাকার বাসিন্দা কাঠ শ্রমিক সাইফুল আলম
জানান, ‘ এটা কী ভাবে হলো আমরা বুঝি না। নির্মাণের পর থেকেই এখানকার খুঁটির বাতি জ্বলেনি। পৌরসভার সাবেক মেয়র এবিএম গোলাম কবিরের আমলে কাজটি
হয়েছে।’বেতাগী পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আরও দেখা গেছে, সড়কের পাশে ৭৯ টি সৌরবাতির ২০টি খুঁটির আগেই কোন অস্তিত্ব নেই। কিছু খুঁটি দাঁড়িয়ে থাকলেও
তার অধিকাংশই বাতি অকার্যকর ও অকেজো, কোনটাতে নিভু নিভু করে জলছে।কোথাও খুঁটি পানিতে পরে আছে, প্লেট ভেঙেগেছে। পৌরসভার সব সড়কেরই প্রায়
একই চিত্র।এলাকাবাসীর অভিযোগ, পৌরসভাকে বার বার জানানো সত্বেও তারা কোনো ব্যবস্থা
নেয়নি। বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড়ে সড়কের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।তবুও প্রকল্পে সৌরবাতির খুঁটিগুলো মেরামতসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য কোন
ব্যবস্থা নেই।পৌর কর্তৃপক্ষের দাবি, পৌরসভায় জনবলের সংকট রয়েছে। একজন স্থায়ী বৈদ্যুতিক
মিস্ত্রী ও একজন অস্থায়ী লাইনম্যান দিয়ে সব কিছু রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়না।আলমগীর হোসেন নামে এক এলাকাবাসী বলেন,‘অন্ধকারে দেখা যায় না, যদি মোড়ে
মোড়ে বাতিগুলো ঠিক মতো থাকত, তাহলে এমন হত না।’
কবি নজরুলের মাধ্যমিক বিদ্যালয় মোড়ের দোকানদার আবুল কালাম বলেন,‘‘আমার দোকানের সামনে খুঁটিটি স্থাপনের পর ভেঙে পরে। কর্তৃপক্ষকে বলা সত্বেও
তাদের টনক নড়েনি। বাধ্য হয়ে আমরা চেষ্টা করেও এখনো বাতি জ¦ালাতে পারিনি।’অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, দরপত্রের মাধ্যমে কাজটি শুরু হলেও এটি যেন কাগজে-কলমের প্রকল্পে পরিনত হয়। যেসব সৌরবাতি লাগানো হয়েছে, তা টেকসই নয়। চায়নার নিম্নমানের মালামাল ব্যবহারের কারণে কাজ শেষ হওয়ার ৬ মাসের মধ্যেই
সমস্যার শুরু হয়। নষ্ট হলেওতো সৌরবাতিগুলো সচল করার কথা ছিল। কিন্ত কেউ কোনো দিন খোঁজ খবরও নেয়নি। এতো দামি জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে থাকলেও কর্তৃপক্ষের কোন মাথা ব্যথা নেই। ফলে প্রকল্পটি আলোদানের পরিবর্তে অন্ধকারেই রয়েগেছে-এ অভিব্যক্তি স্থানীয়দের।’এ বিষয় নিয়ে কথা হয় ঠিকদারি প্রতিষ্ঠানের প্রোপাইটার মো: সোহরাব হোসেনের
সাথে। তার দাবি বেতাগী পৌরসভায় পরিবেশবান্ধব সৌরবাতি স্থাপনে জিআই পাইপ ও চায়না থেকে আমদানিকৃত দেশের সবচেয়ে কোয়ালিটি সম্পন্ন মালামাল ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হয়ত সৌরবাতিগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। তবে আমরা সবাই জানি চায়নার মালের দাম ও স্থায়ীত্ব কম এটাতো কিছুই করার নেই।
জাপানের মালমাল ব্যবহার করতে গেলে এর চেয়ে কয়েকগুন খরচ বেশি হবে। ঐ টাকায়
তা দিয়ে আরও কয়েকটি বাতি স্থাপন করা যেত। আমাদের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের মেরামতের দায়িত্ব ছিল এক বছর। এরপর পৌরসভার তত্ত্বাবধানে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব।
প্রকল্প গ্রহন ও বাস্তবানের আগে কাউন্সিলর ও ভুক্তভোগিদের কোন মতামত নেওয়া হয়নি। বেতাগী পৌরসভার তৎকালীণ প্যানেল মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন
মাসুদুর রহমান খান। তার অভিব্যক্তি, সঠিকভাবে কাজটি সম্পন্নের দাবি করা হলেও বাস্তবে প্রায় ১ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কতভাগ কাজ হয়েছে সরাসরি এসে
কেউ দেখলে ধারনা মিলবে। শুনেছি কাজটির অনুমোদন দেওয়ার সময়ে প্রকল্প সংশ্লিস্টরা কোন কোম্পানী থেকে মালামাল সরবরাহ করা হবে তা আগেই নির্ধারন করে দেওয়া হয়েছিল। প্রকল্প অনুমোদন ও অভিযোগের বিষয়ে বেতাগী পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো:
জসীম উদ্দীন বলেন, কয়েকটি ধাপ পার হয়ে প্রকল্প অনুমোদন হয়। জলবায়ু সংশ্নিষ্টতা না থাকলে প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার সুযোগ নেই।
অভিযোগের বিষয়ে তিনি জানান, পৌরসভায় পরিবেশবান্ধব সৌরবাতি স্থাপনের কাজটি
দরপত্রের মাধ্যমে স্বচ্ছতার সহিত বাস্তবায়ন করা হয়। এর সাথে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ও সরকারের অনেকগুলো বিভাগ সংশ্লিষ্ট রয়েছে। তার পরেও যদি কোন
সমস্যা থাকে তার দায়ভার শুধু পৌরসভার একার নয়।
স্থানীয়দের ভাষ্য, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের অর্থায়নে বেতাগী পৌরসভার গৃহীত সৌর সড়কবাতি প্রকল্পটির সুফল মেলেনি। জলবায়ূ কর্মকান্ডে
জড়িত স্থানীয় বিশিষ্টজনের মন্তব্য,সড়কবাতি স্থাপনের মতো প্রকল্প অনেক ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে পুরোপুরি সম্পর্কিত কিংবা সরাসরি ভূমিকা রাখছে কিনা এ ক্ষেত্রে এর উদ্দেশ্য ও বাস্তবায়ন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। স্থানীয় চাহিদা ও বাস্তব পরিস্থিতি যাচাই,পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন না করে প্রকল্পটি নেওয়ায় প্রকল্পের যে লক্ষ্য ছিলো তার কার্যকারিতা প্রমাণ করতে না পারায় প্রকল্পটি প্রত্যাশিত ফল দিতে ব্যর্থ হয়েছে যা একটি বড় সংকট ও সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অযথা অর্থ অপচয় হচ্ছে। সৌরবাতি প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনের কতটুকু লাভ হয়েছে এ
প্রসঙ্গে বেতাগী পৌরসভার বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী বাবুল হোসেন বলেন, আশা কর ছিলাম প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হলে সঞ্চালন লাইনের বাতির সংখ্যা ও বৈদ্যুতিক বিলের চাপ কমিয়ে আনা যাবে। কিন্ত এখন দেখছি তেমন কোন লাভ হয়নি। বিলের সেই বোঝা রয়েইগেছে। বর্তমানে প্রতিমাসে পৌরসভাকে ৬ শত ৫০টি সঞ্চালন লাইনের বৈদ্যুতিক বাতির বিল বাবাদ ৫০ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। তাছাড়াও একটি সৌরবাতি স্থাপন ও নির্মাণে যে পরিমাণের অর্থ ব্যয় হয়েছে তা দিয়ে সঞ্চালন লাইনের অন্তত: ৫টি বাতির স্থাপন করা যেত। একটি সৌরবাতি নষ্ট হলে ন্যুনতম ২ হাজার ৫০০ টাকায় মেরামত ব্যয় হয়। কিন্ত স্বাভাবিকভাবে এত টাকা দিয়ে সবসময় মেরামত করা সম্ভব পর হয়ে উঠেনা।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় নেওয়া এই প্রকল্পের কার্যক্রম দেখে ক্ষোভ ও হতাশায় সমাজের নানা শ্রেণির প্রতিনিধিরাও। বেতাগী উন্নয়ন আন্দোলনের সভাপতি সহকারি অধ্যাপক আবুল বাসার খান বলেন, ‘এখানের পরিবেশ ও
প্রয়োজন বিবেচনায় না নিয়ে প্রকল্প নেওয়ায় তা জনগণের কাজে আসছে না। ফান্ডের টাকা গচ্চা যাচ্ছে।’
বেতাগী উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মহসীন খান বলেন,প্রকল্প অনুমোদন, বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকায় জলবায়ু
পরিবর্তন ফান্ডের উদ্দেশ্য ব্যহত হচ্ছে। এছাড়া প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষ ও অভিজ্ঞজনদের কোনো মত নেওয়া হয়নি। অবশ্য ২০২৩ সালের দিকে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। তৎকালীন সময় সৌরবাতি স্থাপন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে অনেক কমকর্তাগণ দেশের পটপরিবর্তনে অন্যত্র বদলী হওয়ায় তাদের সাথে চেষ্টা
করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
বেতাগী পৌরসভার প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার হরেকৃষ্ণ অধিকারী নতুন দায়িত্ব নেওয়ায় তিনি এসব ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাননি।প্রকল্পের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে ও সংকট সমাধানের জন্য যে প্রতিষ্ঠান সৌর বাতিগুলো স্থাপন করেছিল কিংবা এই ধরনের কাজের সাথে জড়িত ও অভিজ্ঞ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং টেকনিশিয়ান দিয়ে বাতিগুলো সচল করে কার্যকরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি হয়ে পড়েছে স্থানীয়দের এমনই অভিমত।
পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য সৌরবাতি স্থাপন প্রকল্প। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষনের অভাব,অনিয়ম, স্থানীয় চাহিদা,বাস্তব পরিস্থিতি,পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন, গবেষনা ও অভিজ্ঞ মানুষের মতামত যাচাই না করায় প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও খেয়াল-খুশিমতো হাতে নেওয়ায় যা ক্ষতিগ্রস্থ পৌরবাসীর কাজে আসছে না বরং জলবায়ু তহবিলের বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় হয়েছে।
দেশের উপকূলীয় এ জনপদে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের অর্থায়নে পৌরসভার বিভিন্ন গুরুত্বপর্ণ সড়কে সৌরবাতি স্থাপনের পাঁচ থেকে ছয় মাস পর থেকেই বাতিগুলো নষ্ট ও অস্তিত্ব হারাতে থাকে। ঠিকমত জ্বলছে কি-না মাঝে মাঝে তা পরীক্ষা করার কথা থাকলেও স্থাপনের পর কোনো খোঁজই রাখেনি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও পৌরসভা। পৌর নাগরিক সমাজের অভিমত ভুক্তভোগি ও অভিজ্ঞদের মত
নিয়ে কার্যকরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে জলবায়ূ ফান্ডের এ প্রকল্পের ক্ষতি ও সমস্যা অনেকটা পুষিয়ে উঠা সম্ভব হবে। সরজমিনে দেখামেলে, সন্ধ্যা হলেই সড়কে আঁধার নেমে আসে। বাড়ছে দূর্ঘটনা,চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রভাব মোকাবেলা করা, পরিবেশের উপর কার্বন নি:সরণ কমানো এবং সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়ানো কিন্ত যে উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি নেয়া হয়েছিল, তা কার্যত ব্যহত হয়েছে। পৌরবাসীর এতে ক্ষোভের শেষ
নেই। ‘জলবায়ু’, ‘পরিবর্তন’, ‘প্রভাব’ আর 'মোকাবিলা- এই চার শব্দ জুড়ে দিয়ে নেওয়া হয় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টফান্ডের (সিসিটিএফ) প্রকল্প। কিন্ত সংকট কাটিয়ে উঠতে এর প্রয়োজনীয়তা কতখানি- তা যাচাইয়ের নজিরও তেমন একটা নেই। স্থানীয়দের বক্তব্য এখানেও তাই ঘটেছে। বেতাগী পৌরসভার তথ্যানুযায়ী, পৌরসভা প্রস্তাবিত এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন অধিশাখা অনুমোদিত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এ প্রকল্পের প্রতিটি ১ লাখ ২৫ হাজার ৫০০ টাকা করে মোট ৯৯ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ে পরিবেশবান্ধব সোলার স্ট্রিট লাইট ফিটিং ও ফিক্সিং কাজ করা হয়। ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাকেরগঞ্জের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স উপকূল
সোলার সিষ্টেম পৌর দরপত্রের কার্যাদেশ পেয়ে ২০২৩ সালে ফ্রেরুয়ারিতে কাজ সম্পন্ন করে। বেতাগী পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্তম্ভ ‘দুর্জয় বেতাগী’ সাবেক মেয়র শাহজাহান কবিরের বাড়ী পর্যন্ত পাকা সড়কের পাশে স্থাপন করা ৮টি সৌরবাতির সেখানে ৬৩,৬৪,৬৫ ও ৬৬ নম্বর ৪টি
খুঁটির সামান্যও কোন অস্তিত্ব নেই। আর ৬১ নম্বর খুঁটি পানিতে পরে আছে।
সঙ্গে আনুষঙ্গিক অন্যান্য যন্ত্রাংশও পানিতে কাদায় লেপ্টে আছে এমনি হ-য-ব-র-ল।
কচুয়া-বেতাগী পুরানো খেযাঘাট এলাকার বাসিন্দা কাঠ শ্রমিক সাইফুল আলম
জানান, ‘ এটা কী ভাবে হলো আমরা বুঝি না। নির্মাণের পর থেকেই এখানকার খুঁটির বাতি জ্বলেনি। পৌরসভার সাবেক মেয়র এবিএম গোলাম কবিরের আমলে কাজটি
হয়েছে।’বেতাগী পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আরও দেখা গেছে, সড়কের পাশে ৭৯ টি সৌরবাতির ২০টি খুঁটির আগেই কোন অস্তিত্ব নেই। কিছু খুঁটি দাঁড়িয়ে থাকলেও
তার অধিকাংশই বাতি অকার্যকর ও অকেজো, কোনটাতে নিভু নিভু করে জলছে।কোথাও খুঁটি পানিতে পরে আছে, প্লেট ভেঙেগেছে। পৌরসভার সব সড়কেরই প্রায়
একই চিত্র।এলাকাবাসীর অভিযোগ, পৌরসভাকে বার বার জানানো সত্বেও তারা কোনো ব্যবস্থা
নেয়নি। বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড়ে সড়কের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।তবুও প্রকল্পে সৌরবাতির খুঁটিগুলো মেরামতসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য কোন
ব্যবস্থা নেই।পৌর কর্তৃপক্ষের দাবি, পৌরসভায় জনবলের সংকট রয়েছে। একজন স্থায়ী বৈদ্যুতিক
মিস্ত্রী ও একজন অস্থায়ী লাইনম্যান দিয়ে সব কিছু রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়না।আলমগীর হোসেন নামে এক এলাকাবাসী বলেন,‘অন্ধকারে দেখা যায় না, যদি মোড়ে
মোড়ে বাতিগুলো ঠিক মতো থাকত, তাহলে এমন হত না।’
কবি নজরুলের মাধ্যমিক বিদ্যালয় মোড়ের দোকানদার আবুল কালাম বলেন,‘‘আমার দোকানের সামনে খুঁটিটি স্থাপনের পর ভেঙে পরে। কর্তৃপক্ষকে বলা সত্বেও
তাদের টনক নড়েনি। বাধ্য হয়ে আমরা চেষ্টা করেও এখনো বাতি জ¦ালাতে পারিনি।’অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, দরপত্রের মাধ্যমে কাজটি শুরু হলেও এটি যেন কাগজে-কলমের প্রকল্পে পরিনত হয়। যেসব সৌরবাতি লাগানো হয়েছে, তা টেকসই নয়। চায়নার নিম্নমানের মালামাল ব্যবহারের কারণে কাজ শেষ হওয়ার ৬ মাসের মধ্যেই
সমস্যার শুরু হয়। নষ্ট হলেওতো সৌরবাতিগুলো সচল করার কথা ছিল। কিন্ত কেউ কোনো দিন খোঁজ খবরও নেয়নি। এতো দামি জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে থাকলেও কর্তৃপক্ষের কোন মাথা ব্যথা নেই। ফলে প্রকল্পটি আলোদানের পরিবর্তে অন্ধকারেই রয়েগেছে-এ অভিব্যক্তি স্থানীয়দের।’এ বিষয় নিয়ে কথা হয় ঠিকদারি প্রতিষ্ঠানের প্রোপাইটার মো: সোহরাব হোসেনের
সাথে। তার দাবি বেতাগী পৌরসভায় পরিবেশবান্ধব সৌরবাতি স্থাপনে জিআই পাইপ ও চায়না থেকে আমদানিকৃত দেশের সবচেয়ে কোয়ালিটি সম্পন্ন মালামাল ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হয়ত সৌরবাতিগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। তবে আমরা সবাই জানি চায়নার মালের দাম ও স্থায়ীত্ব কম এটাতো কিছুই করার নেই।
জাপানের মালমাল ব্যবহার করতে গেলে এর চেয়ে কয়েকগুন খরচ বেশি হবে। ঐ টাকায়
তা দিয়ে আরও কয়েকটি বাতি স্থাপন করা যেত। আমাদের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের মেরামতের দায়িত্ব ছিল এক বছর। এরপর পৌরসভার তত্ত্বাবধানে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব।
প্রকল্প গ্রহন ও বাস্তবানের আগে কাউন্সিলর ও ভুক্তভোগিদের কোন মতামত নেওয়া হয়নি। বেতাগী পৌরসভার তৎকালীণ প্যানেল মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন
মাসুদুর রহমান খান। তার অভিব্যক্তি, সঠিকভাবে কাজটি সম্পন্নের দাবি করা হলেও বাস্তবে প্রায় ১ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কতভাগ কাজ হয়েছে সরাসরি এসে
কেউ দেখলে ধারনা মিলবে। শুনেছি কাজটির অনুমোদন দেওয়ার সময়ে প্রকল্প সংশ্লিস্টরা কোন কোম্পানী থেকে মালামাল সরবরাহ করা হবে তা আগেই নির্ধারন করে দেওয়া হয়েছিল। প্রকল্প অনুমোদন ও অভিযোগের বিষয়ে বেতাগী পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো:
জসীম উদ্দীন বলেন, কয়েকটি ধাপ পার হয়ে প্রকল্প অনুমোদন হয়। জলবায়ু সংশ্নিষ্টতা না থাকলে প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার সুযোগ নেই।
অভিযোগের বিষয়ে তিনি জানান, পৌরসভায় পরিবেশবান্ধব সৌরবাতি স্থাপনের কাজটি
দরপত্রের মাধ্যমে স্বচ্ছতার সহিত বাস্তবায়ন করা হয়। এর সাথে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ও সরকারের অনেকগুলো বিভাগ সংশ্লিষ্ট রয়েছে। তার পরেও যদি কোন
সমস্যা থাকে তার দায়ভার শুধু পৌরসভার একার নয়।
স্থানীয়দের ভাষ্য, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের অর্থায়নে বেতাগী পৌরসভার গৃহীত সৌর সড়কবাতি প্রকল্পটির সুফল মেলেনি। জলবায়ূ কর্মকান্ডে
জড়িত স্থানীয় বিশিষ্টজনের মন্তব্য,সড়কবাতি স্থাপনের মতো প্রকল্প অনেক ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে পুরোপুরি সম্পর্কিত কিংবা সরাসরি ভূমিকা রাখছে কিনা এ ক্ষেত্রে এর উদ্দেশ্য ও বাস্তবায়ন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। স্থানীয় চাহিদা ও বাস্তব পরিস্থিতি যাচাই,পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন না করে প্রকল্পটি নেওয়ায় প্রকল্পের যে লক্ষ্য ছিলো তার কার্যকারিতা প্রমাণ করতে না পারায় প্রকল্পটি প্রত্যাশিত ফল দিতে ব্যর্থ হয়েছে যা একটি বড় সংকট ও সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অযথা অর্থ অপচয় হচ্ছে। সৌরবাতি প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনের কতটুকু লাভ হয়েছে এ
প্রসঙ্গে বেতাগী পৌরসভার বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী বাবুল হোসেন বলেন, আশা কর ছিলাম প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হলে সঞ্চালন লাইনের বাতির সংখ্যা ও বৈদ্যুতিক বিলের চাপ কমিয়ে আনা যাবে। কিন্ত এখন দেখছি তেমন কোন লাভ হয়নি। বিলের সেই বোঝা রয়েইগেছে। বর্তমানে প্রতিমাসে পৌরসভাকে ৬ শত ৫০টি সঞ্চালন লাইনের বৈদ্যুতিক বাতির বিল বাবাদ ৫০ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। তাছাড়াও একটি সৌরবাতি স্থাপন ও নির্মাণে যে পরিমাণের অর্থ ব্যয় হয়েছে তা দিয়ে সঞ্চালন লাইনের অন্তত: ৫টি বাতির স্থাপন করা যেত। একটি সৌরবাতি নষ্ট হলে ন্যুনতম ২ হাজার ৫০০ টাকায় মেরামত ব্যয় হয়। কিন্ত স্বাভাবিকভাবে এত টাকা দিয়ে সবসময় মেরামত করা সম্ভব পর হয়ে উঠেনা।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় নেওয়া এই প্রকল্পের কার্যক্রম দেখে ক্ষোভ ও হতাশায় সমাজের নানা শ্রেণির প্রতিনিধিরাও। বেতাগী উন্নয়ন আন্দোলনের সভাপতি সহকারি অধ্যাপক আবুল বাসার খান বলেন, ‘এখানের পরিবেশ ও
প্রয়োজন বিবেচনায় না নিয়ে প্রকল্প নেওয়ায় তা জনগণের কাজে আসছে না। ফান্ডের টাকা গচ্চা যাচ্ছে।’
বেতাগী উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মহসীন খান বলেন,প্রকল্প অনুমোদন, বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকায় জলবায়ু
পরিবর্তন ফান্ডের উদ্দেশ্য ব্যহত হচ্ছে। এছাড়া প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষ ও অভিজ্ঞজনদের কোনো মত নেওয়া হয়নি। অবশ্য ২০২৩ সালের দিকে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। তৎকালীন সময় সৌরবাতি স্থাপন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে অনেক কমকর্তাগণ দেশের পটপরিবর্তনে অন্যত্র বদলী হওয়ায় তাদের সাথে চেষ্টা
করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
বেতাগী পৌরসভার প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার হরেকৃষ্ণ অধিকারী নতুন দায়িত্ব নেওয়ায় তিনি এসব ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাননি।প্রকল্পের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে ও সংকট সমাধানের জন্য যে প্রতিষ্ঠান সৌর বাতিগুলো স্থাপন করেছিল কিংবা এই ধরনের কাজের সাথে জড়িত ও অভিজ্ঞ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং টেকনিশিয়ান দিয়ে বাতিগুলো সচল করে কার্যকরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি হয়ে পড়েছে স্থানীয়দের এমনই অভিমত।
Comment / Reply From
You May Also Like
Latest News
Vote / Poll
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলা বন্ধ করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ যথেষ্ট বলে মনে করেন কি?
হ্যাঁ
না
মন্তব্য নেই
0%
0%
0%
Popular Posts
Archive
Please select a date!
Submit