
একে একে নিভে গেছে সাতক্ষীরার ১৩ সিনেমা হল, টিকে আছে শুধু ‘লাবণী’
এসএম শহীদুল ইসলাম, সাতক্ষীরা
একসময় সিনেমার শো মানেই ছিল উৎসব। সাতক্ষীরার সিনেমা হলগুলোতে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হতো হল মালিকদের। টিকিট না পেয়ে দর্শকদের ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটতো হরহামেশা। অথচ এখন সেই চিত্র উল্টো। মাত্র কয়েকজন দর্শক নিয়ে চলছে শো। জেলার ঐতিহ্যবাহী লাবণী সিনেমা হল ছাড়া সবগুলোই আজ বন্ধ হয়ে গেছে।
সাতক্ষীরার লাবণী সিনেমা হলের ম্যানেজার জারদিসুর রহমান এক হতাশা ভরা কণ্ঠে বললেন—
“একসময় গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ সিনেমা দেখতে আসতো। কিন্তু এখন মানুষ আর হলে আসে না। দুই-চারজন নিয়েই শো চালাতে হয়। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট সব কাড়ল আমাদের দর্শক।”
এক সময় জেলায় ছিল ১৪টি সিনেমা হল। এর মধ্যে শ্যামনগরের লক্ষ্মী ও সুন্দরবন, কালিগঞ্জের জ্যাকি, দেবহাটার লাইট হাউজ ও ইছামতি, কলারোয়ার জোনাকি ও পলাশ, আশাশুনির সোনালী, পাটকেলঘাটার চ্যালেঞ্জ ও মামুন এবং তালার ফাল্গুনী—সবগুলোই আজ অতীত। সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গেছে সাতক্ষীরার সঙ্গীতা সিনেমা হলও।
সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে একাধিক কারণ কাজ করেছে। প্রথমে ফিতা ক্যাসেট, তারপর ডিশ লাইনের সম্প্রসারণ, আর সবশেষে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের আগ্রাসন সিনেমা হলগুলোকে ধ্বংস করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের সিনেমার মানোন্নয়ন না হওয়া, দর্শকের ব্যস্ততা, হলগুলোর দুর্বল অবকাঠামো এবং নিরাপত্তাহীনতা।
২০০২ সালে সাতক্ষীরার রক্সি সিনেমা হল ও গুড়পুকুর মেলার সার্কাসে বোমা হামলার ঘটনাও দর্শক বিমুখতায় বড় ভূমিকা রেখেছিল।
সাতক্ষীরার সবচেয়ে পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী এই লাবণী সিনেমা হলের সূচনা ১৯১৩ সালে। তৎকালীন জমিদার প্রাণ নাথ রায় চৌধুরীর আত্মীয় বিনয় কৃষ্ণ ঘোষ ২৯ শতক জমি দান করেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য। সেখানে গড়ে ওঠে দরবার হল, যেখানে নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো নিয়মিত। ষাটের দশকে মোজাম্মেল হক শুরু করেন সাপ্তাহিক সিনেমা প্রদর্শনী। স্বাধীনতার পর এটি ‘লাবণী সিনেমা হল’ নামে পূর্ণাঙ্গ যাত্রা শুরু করে।
বর্তমানে সেখানে চলছে পুরোনো সিনেমা ‘ড্যাম কেয়ার’। দর্শক সংখ্যা—মোটে পাঁচজন। এদের মধ্যে তরুণদের দেখা মেলে না। বেশিরভাগই বয়স্ক মানুষ কিংবা রিকশা-ভ্যান চালক।
ম্যানেজার জারদিসুর রহমান বললেন—
“তিন ঘণ্টা বসে সিনেমা দেখার সময় কার আছে এখন? স্মার্টফোনেই মানুষ সবকিছু পাচ্ছে। ভালো সিনেমা আনতে খরচ হয় অনেক, কিন্তু দর্শক নেই। মাঝেমধ্যে ঈদে বা উৎসবে ভিড় হয়, তবে দু’একদিন পরই আবার শূন্যতা।”
এখন লাবণী হল ঘিরে চলছে নতুন বিতর্ক। জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদের একাংশ চান ভবনটি ভেঙে সেখানে বাণিজ্যিক মার্কেট নির্মাণ করতে। অন্যদিকে সংস্কৃতিমনা মানুষরা বলছেন, এটি ভাঙা নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স গড়ে তোলা উচিত। সেখানে থাকবে থিয়েটার, আবৃত্তি, নৃত্য, আধুনিক সিনেপ্লেক্স ও কমিউনিটি সেন্টার।
সাতক্ষীরা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ বললেন—
“বিনয় কৃষ্ণ ঘোষ এ জমি দিয়েছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য। মার্কেট হলে চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে নাটক, সিনেমা ও সংস্কৃতির ইতিহাস। বরং কমপ্লেক্স হলে আধুনিক বিনোদনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিকাশও ঘটবে।”
যেখানে একসময় সিনেমা হল ছিল মানুষের বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র, সেখানে এখন স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার খেসারত দিতে হয়েছে সাতক্ষীরার সিনেমা হলগুলোকে। তবু শেষ আশার প্রদীপ হয়ে ধুকছে লাবণী সি
Comment / Reply From
You May Also Like
Latest News
Vote / Poll
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলা বন্ধ করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ যথেষ্ট বলে মনে করেন কি?